কর্জ নিয়েও কি কুরবানী করতে হবে?
কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য কি পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে?
সময়ের মধ্যে শর্তাবলী পাওয়া গেলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে
কুরবানীর ১২টি মাদানী ফুল
প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! যে ব্যক্তি কুরবানী করার সামর্থ্য রাখা সত্তেও নিজের ওয়াজিব কুরবানী আদায় করে না। তাদের জন্য চিন্তার বিষয় এটা যে, প্রথমে এটা কি কম ক্ষতি যে, কুরবানী না করার কারণে এত বড় সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হল, আরো সে গুনাহগার এবং জাহান্নামের হকদার হল। ‘ফতোওয়ায়ে আমজাদীয়া’র ৩য় খন্ডের ৩১৫ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে: “যদি কারো উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়, আর ঐ সময় তার কাছে টাকা না থাকে, তবে সে কর্জ নিয়ে বা কোন জিনিস বিক্রি করে হলেও কুরবানী করবে।”
কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য কি পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে?
প্রত্যেক বালিগ, স্থায়ী বাসিন্দা, মুসলমান পুরুষ-নারী, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের উপর কুরবানী ওয়াজিব। (আলমগিরী, ৫ম খন্ড, ২৯২ পৃষ্ঠা) নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, ঐ ব্যক্তির নিকট সাড়ে ৫২ তোলা রূপা অথবা তত পরিমাণ সম্পদের মূল্য অথবা তত পরিমাণ সম্পদের ব্যবসার মাল অথবা তত পরিমাণ সম্পদের মৌলিক প্রয়োজন ছাড়া সরঞ্জাম হোক এবং তার উপর আল্লাহ্ তাআলা বা বান্দাদের এত কর্জ না থাকে যা আদায় করতে গিয়ে বর্ণিত নিসাব বাকী থাকবে না। ফোকাহায়ে কেরাম رَحِمَہُمُ اللہُ السَّلَام বলেন: মৌলিক প্রয়োজন (অর্থাৎ জীবনের প্রয়োজনীয়তা) থেকে ঐ জিনিস উদ্দেশ্য যেগুলোর সাধারণ ভাবে মানুষের প্রয়োজন হয় এবং এগুলো ছাড়া জীবন ধারণ করা খুবই কঠিন আর অভাব অনুভূত হয় যেমন- থাকার ঘর, পরিধানের কাপড়, বাহন, ইলমে দ্বীনের কিতাবসমূহ এবং পেশার সরঞ্জাম ইত্যাদি। (আল হিদায়া, ১ম খন্ড, ৯৬ পৃষ্ঠা)
যদি ‘মৌলিক প্রয়োজন এর সংজ্ঞা চোখের সামনে রাখা হয়, তবে ভালভাবে জানা যাবে যে, “আমাদের ঘরের অনেক জিনিস” এমন রয়েছে, যা মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভূক্ত নয়। এমনকি যদি ঐ গুলোর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা’র সমপরিমাণে পৌঁছে তবে কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। আমার আক্বা আ‘লা হযরত, মাওলানা শাহ ইমাম আহমদ রযা খান رَحۡمَۃُ اللہِ تَعَالٰی عَلَیْہِ কে প্রশ্ন করা হল, “যদি যায়েদের নিকট থাকার ঘর ছাড়া দু’একটি আরো (বেশি) ঘর থাকে, তবে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে কি-না? উত্তর: ওয়াজিব। যখন শুধু ঘর বা তার এবং তার সম্পদে ‘মৌলিক প্রয়োজন থেকে বেশি হয়, (অর্থাৎ- এতটুকু সম্পদ, যা সাড়ে বায়ান্ন তোলা চাঁদির সমপরিমাণের মূল্যে পৌছে। যদিও ঐ ঘরগুলো ভাড়ার ভিত্তিতে চালায় বা খালি পড়ে আছে বা সাধারণ জমি বরং (যদি) বসবাসের ঘর এত বড় যে, তার এক অংশ ঐ ব্যক্তির ঠান্ডা এবং গরম উভয় মৌসুমে বসবাসের জন্য যথেষ্ট এবং অপর অংশ প্রয়োজন থেকে অতিরিক্ত আর এ (অপর অংশের) মূল্য একাকী বা এরকম মৌলিক প্রয়োজন) থেকে অতিরিক্ত সম্পদের সাথে মিলে নিসাব পর্যন্ত পৌঁছে। তখনও কুরবানী ওয়াজিব। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া, ২০তম খন্ড, ৩৬১ পৃষ্ঠা)
সময়ের মধ্যে শর্তাবলী পাওয়া গেলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে
সম্পদ এবং অন্যান্য শর্তাবলী কুরবানীর দিনসমূহের (অর্থাৎ ১০ই জিলহজ্জের সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে ১২ই জিলহজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত) মধ্যে পাওয়া গেলে, তখনই কুরবানী ওয়াজিব হবে। এ মাসআলা বর্ণনা করতে গিয়ে সদরুশ শরীয়া, বদরুত তরীকা হযরত আল্লামা মাওলানা মুফতী আমজাদ আলী আযমী رَحۡمَۃُ اللہِ تَعَالٰی عَلَیْہِ “বাহারে শরীয়াত” এর মধ্যে বলেন: এটা আবশ্যক নয় যে, দশম তারিখেই কুরবানী করে ফেলবে। এটার জন্য অবকাশ রয়েছে, সম্পূর্ণ সময়ে যখন চাইবে করতে পারবে (১০ই জিলহজ্জের সকাল) তার উপযুক্ত ছিল না। ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী পাওয়া যায়নি আর শেষ সময়ে (অর্থাৎ ১২ই জিলহজ্জের সূর্যাস্তের পূর্বে) উপযুক্ত হয়ে গেল অর্থাৎ কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলী পাওয়া গেল, তবে তার উপর (কুরবানী) ওয়াজিব হয়ে গেল এবং যদি শুরুর সময়ে ওয়াজিব ছিল আর এখনো (কুরবানী) করেনি এবং শেষ সময়ে শর্তাবলী বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে কুরবানী ওয়াজিব রইলনা। (আলমগীরি, ৫ম খন্ড, ২৯৩ পৃষ্ঠা)
কুরবানীর ১২টি মাদানী ফুল
(১) কিছু লোক সম্পূর্ণ পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কুরবানী দিয়ে থাকে। অথচ অনেক সময় নিছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার কারণে পরিবারের একাধিক সদস্যের উপর কুরবানী দেওয়া ওয়াজিব হয়েছে। এদের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক কুরবানী দিতে হবে। একটি ছাগল যা সবার পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়া হয়েছে, কারো পক্ষ থেকে ওয়াজিব আদায় হয়নি, কেননা ছাগল এক অংশের চেয়ে বেশি অংশ হতে পারেনা। কোন এক নির্ধারিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ছাগল কুরবানী হতে পারে।
(২) গরু, মহিষ এবং উট দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানী হতে পারে। (ফতোওয়ায়ে আলমগীরী, ৫ম খন্ড, ৩০৪ পৃষ্ঠা)
(৩) নাবালেগ সন্তানের উপর যদিও কুরবানী ওয়াজিব নয়, তবুও তার পক্ষ থেকে কুরবানী দেওয়া উত্তম (এবং এক্ষেত্রে তাদের অনুমতি নেওয়ারও প্রয়োজন নেই)। প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান বা স্ত্রীর পক্ষ থেকে কুরবানী দিতে চাইলে তাদের অনুমতি নিতে হবে। যদি তাদের অনুমতি ব্যতীত তাদের জন্য কুরবানী দেওয়া হয় তাহলে তাদের পক্ষ থেকে ওয়াজিব আদায় হবেনা। (ফতোওয়ায়ে আলমগীরী, ৫ম খন্ড, ২৯৩ পৃষ্ঠা। বাহারে শরীয়াত, ৩য় খন্ড, ৪২৮ পৃষ্ঠা) অনুমতি দু’ধরনের হয়ে থাকে; (১) প্রকাশ্য ভাবে। যেমন- তাঁদের মধ্য থেকে কেউ যদি সুস্পষ্ট ভাবে বলে দেয় যে, “আমার পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়ে দাও।” (২) প্রমাণ সহকারে (টঘউঊজ ঝঞঙঙউ) (যেমন- অনুমতি বুঝা যায় এমন আচরণের মাধ্যমে) যেমন- সে নিজের স্ত্রী কিংবা সন্তানদের পক্ষ থেকে কুরবানী আদায় করছে আর তারাও (স্ত্রী, সন্তানরা) এ ব্যাপারে অবগত আছে এবং সন্তুষ্টও রয়েছে। (ফতোওয়ায়ে আহলে সুন্নাত, অপ্রকাশিত)
(৪) কুরবানীর সময় কুরবানী করাটাই আবশ্যক। অন্য কোন বস্তু কুরবানীর স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। যেমন পশু কুরবানী করার পরিবর্তে পশুটি ছদকা করে দেওয়া বা এটির মূল্য দান করে দেওয়া যথেষ্ট নয়। (ফতোওয়ায়ে আলমগীরী, ৫ম খন্ড, ২৯৩ পৃষ্ঠা। বাহারে শরীয়াত, ৩য় খন্ড, ৩৩৫ পৃষ্ঠা)
(৫) কুরবানীর পশুর বয়স:- উট ৫ বৎসর, গরু ২ বৎসর, ছাগল, দুম্বা-দুম্বী, ভেড়া-ভেড়ী ১ বছর। এর চেয়ে কম বয়সী হলে কুরবানী জায়েয হবেনা। বেশি হলে জায়েয বরং উত্তম। তবে দুম্বা কিংবা ভেড়ার ৬ মাস বয়সী বাচ্চা যদি দূর থেকে দেখতে এক বছর বয়স্ক দুম্বা, কিংবা ভেড়ার মত বড় মনে হয় তবে তা দ্বারা কুরবানী জায়েয। (দুররে মুখতার, ৯ম খন্ড, ৫৩৩ পৃষ্ঠা) স্মরণ রাখবেন! সাধারণত ৬ মাস বয়সের দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা বৈধ নয়। এটি এই পরিমাণ মোটা ও বড় হওয়া জরুরী যে, দূর থেকে দেখতে ১বছর বয়স হয়েছে বলে মনে হতে হবে। দূর থেকে দেখতে ৬মাস বয়সী নয় বরং ১ বছর থেকে একদিন কম এমন দুম্বা বা ভেড়ার বাচ্চাও দূর থেকে দেখতে যদি পূর্ণ ১ বছর বয়সী মনে না হয় তবে ঐ পশু দ্বারা কুরবানী হবেনা।
(৬) কুরবানীর পশু ত্রুটি মুক্ত হওয়া আবশ্যক। যদি সামান্য ত্রুটি থাকে যেমন; কান ছিঁড়া বা কানে ছিদ্র থাকা। ঐ পশু দিয়ে কুরবানী করলে তা মাকরূহ হবে। আর বেশি ত্রুটি থাকলে কুরবানী হবেনা। (বাহারে শরীয়াত, ৩য় খন্ড, ৩৪০ পৃষ্ঠা)
ত্রুটিপূর্ণ পশুর বিবরণ, যা দ্বারা কুরবানী হয় না
(৭) এমন পাগল পশু যা বিচরণ করে না। এতই দূর্বল যে হাড়ের ভিতর মগজ নেই (এটির চিহ্ন হল, সেটি রুগ্ন হওয়ার কারণে দাঁড়াতে পারছেনা), অন্ধ বা এমন কানা যার অন্ধত্ব প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে, বা এমন অসুস্থ যার অসুস্থতা প্রকাশ্যে বুঝা যাচ্ছে (অর্থাৎ- যেটা অসুস্থতার কারণে ঘাস খায় না অথবা এমন খোঁড়া বা ল্যাংড়া যে কুরবানীর স্থানে পায়ে হেঁটে যেতে পারেনা) যেটার জন্ম থেকে কান না থাকে বা একটি কান না থাকলে, জঙ্গলের পশু যেমন- নীল গাভী, জঙ্গলের ছাগল বা হিজড়া পশু (অর্থাৎ- যেটাতে নারী ও পুরুষ উভয়ের নিদর্শন বিদ্যমান থাকলে) বা জাল্লালা যেটি শুধু ময়লা-আবর্জনা খেয়ে থাকে বা যেটির এক পা কর্তিত, কান ও লেজ এক তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশি কাটা, নাক কাটা হলে, দাঁত না থাকলে, (অর্থাৎ- দাঁত পড়ে গেলে, স্তন কাটা হলে বা স্তন শুকনো হওয়া এ সকল পশু দ্বারা কুরবানী নাজায়েয। ছাগলের এক স্তন শুকনো হওয়া, আর গরু মহিষের দুই স্তন শুকনো হওয়াটা কুরবানী নাজায়েয হওয়ার জন্য যথেষ্ট। (দুররে মুখতার, ৯ম খন্ড, ৫৩৫-৫৩৭ পৃষ্ঠা। বাহারে শরীয়াত, ৩য় খন্ড, ৩৪০-৩৪১ পৃষ্ঠা)
(৮) পশুর জন্ম থেকে শিং না থাকলে ঐ পশু দিয়ে কুরবানী জায়েয হবে। আর যদি শিং ছিল কিন্তু ভেঙ্গে গেছে। যদি গোড়া সহ ভেঙ্গে যায় তবে কুরবানী হবেনা আর যদি উপরে সামান্য ভেঙ্গে যায় গোড়া অক্ষত থাকে তবে কুরবানী হয়ে যাবে। (ফতোওয়ায়ে আলমগীরী, ৫ম খন্ড, ২৯৭ পৃষ্ঠা)
(৯) কুরবানী করার সময় পশু লাফালাফি বা হেচকা-হেচকি করার কারণে দোষত্রুটি সৃষ্টি হয়ে গেল, এ দোষ ক্ষতিকারক নয় অর্থাৎ কুরবানী হয়ে যাবে এবং লাফালাফি, হেচকা-হেচকির দ্বারা দোষত্রুটি সৃষ্টি হয়ে গেল এবং ছুটে পালিয়ে গেল আর শীঘ্রই ধরে আনা হল এবং জবেহ করা হল তখন ও কুরবানী হয়ে যাবে। (বাহারে শরীয়াত, ৩য় খন্ড, ৩৪২ পৃষ্ঠা, দুররে মুখতার রদ্দে মুহতার, ৯ম খন্ড, ৫৩৯ পৃষ্ঠা)
(১০) উত্তম হচ্ছে, পশু যবেহ করার নিয়ম জানা থাকলে নিজের কুরবানী নিজের হাতে করা। যদি ভালভাবে যবেহ করার নিয়ম জানা না থাকে তবে অন্য ব্যক্তিকে কুরবানীর পশু যবেহ করার জন্য নির্দেশ দিবে। তবে সেক্ষেত্রে কুরবানী দেওয়ার সময় নিজে উপস্থিত থাকাটা উত্তম। (ফতোওয়ায়ে আলমগীরী, ৫ম খন্ড, ৩০০ পৃষ্ঠা)
(১১) পশু কুরবানী দেওয়ার পর এটির পেট থেকে জীবিত বাচ্চা বের হলে তাও যবেহ করে দিবে এবং এটির (অর্থাৎ- বাচ্চার মাংস) খাওয়া যাবে। আর মৃত বাচ্চা হলে মৃত জন্তু হিসেবে ফেলে দিবে। (বাহারে শরীয়াত, ৩য় খন্ড, ৩৪৮ পৃষ্ঠা) (মৃত বাচ্চা হলেও কুরবানী হয়ে যাবে এবং ঐ পশুর মাংস খাওয়াতে কোন প্রকারের অসুবিধা নেই।)
(১২) অন্যকে দিয়ে কুরবানীর পশু যবেহ করানোর সময় নিজেও ছুরির উপর হাত রেখে উভয়ে মিলে যবেহ করলে উভয়ের উপর بِسۡمِ اللہ বলা ওয়াজিব। একজনও যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ্ তাআলার নাম ছেড়ে দেয় বা অন্যজন আল্লাহ্ তাআলার নাম নিচ্ছে আমার নেওয়ার প্রয়োজন নেই এই ধারণা করে আল্লাহ্ তাআলার নাম বাদ দেয়, তাহলে উভয় অবস্থায় পশু হালাল হবেনা। (দুররে মুখতার, ৯ম খন্ড, ৫৫১ পৃষ্ঠা)
No comments :
Post a Comment